আমি একটু মনের সুখে মাঝে মাঝে গান করি। আমি কোনো শিল্পী না। শিল্প কী সেটা সংজ্ঞায়িত করার কেউ আমি না। এজন্য আমি ভুল কিছু বললে সেটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। লেখাটায় আমি গানের দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করছি। তবে অন্য ধরনের শিল্পের ক্ষেত্রেও ব্যাপারগুলো একই ভাবে কাজ করে। শিল্প বা আর্ট শব্দটা শুনলে আমাদের মাথায় শুধু ছবি আঁকার কথা আসে এমন না। শিল্প বা আর্ট শব্দটা শুনলে ছবি আঁকা, নাচ, গান, ফটোগ্রাফি, কবিতা এবং আরো অনেক কিছু খেলা করে আমাদের মাথায়।
একটা শিশু যখন প্রথমবারের মতো পৃথিবীটা দেখে, তখন তার চোখের দিকে তাকালে দেখা যায় শুধু বিস্ময়! তার মতো অবাক মানুষ পৃথিবীতে যেন কেউ নেই। "এতো এতো সৃষ্টি?! এতো কিছু কে সৃষ্টি করলো?! কিভাবে সৃষ্টি করলো?!" তার বিস্ময়-চকচকে চোখের দিকে তাকালে শুধু যেনো এই প্রশ্নগুলোই অনুভূত হতে থাকে। সে অবাক হবেই না কেনো? সে তো প্রথমবারের মতো দেখছে এতকিছু। এরপর সে তার মাকে দেখলো। বুঝতে পারলো যে, "নাহ, এতকিছু আমার মায়ের পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব না।" তারপর তার বাবার দিকে মনোযোগ গেলো। বুঝতে পারলো যে, "নাহ, এতকিছু আমার বাবার পক্ষেও সৃষ্টি করা সম্ভব না।" তখন সে চারপাশে তাকালো, আবারও বুঝতে পারলো যে, "নাহ, এতকিছু সৃষ্টি করা এখানের কারো পক্ষেই সম্ভব না।" শিশুটি বড় হতে থাকলো। ধীরে ধীরে তার এইসব প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে গেলো তারই আকাঙ্ক্ষার গোলকধাঁধায়।
এখন আসি গানের কথায়। গান বা মিউজিক মূলত ‘certain arrangement of sounds’. আপনি এখন আশেপাশে খেয়াল করে দেখেন, যা কিছু আপনার কানে আসছে, যা কিছু শুনছেন, সবই শুধুমাত্র ‘sound’ বা শব্দ। যখন এই ‘sound’ বা শব্দগুলো বিচ্ছিন্নভাবে শুনি সেটাকে আমরা ‘noise’ বলে আখ্যায়িত করি। যখন এই শব্দগুলোর ‘mathmetical, geometrical arrangements’ করা হয় তখন সেটাকে আমরা সুর বা মিউজিক বলে আখ্যায়িত করি। যদি ক্লাসিক্যাল মিউজিক এর কথাই ধরি, সেটার পেছনে রয়েছে হরেক রকম গাণিতিক প্যাটার্ন, জ্যামিতিক প্যাটার্ন। কোনো না কোনো ভাবে আমরা ‘sound’ কে সাজাই নতুন কিছু সৃষ্টি করার জন্য। বিচ্ছিন্ন ‘sound’ গুলোকে নির্দিষ্ট বিন্যাস দেওয়ার জন্য আমরা ‘complex geometrical pattern’ গুলো ব্যবহার করি এমনভাবে যাতে নতুন কোনো রূপ সৃষ্টি হয়। সৃষ্টির সাথে ‘sound’ এর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমরা যত সৃষ্টি দেখি তার সবই আসলে ‘sound’ এরই সংমিশ্রণ। কথাটা আপনার কাছে যুক্তিহীন মনে হলে, আমরা একটু ‘quantum mechanics’ এর ‘observer effect’ এর দিকে আসি। মোটা দাগে বললে, যখন কোন কিছুকে দেখার মতো কিছু (observer) থাকে, কেবল তখনই পদার্থের অস্তিত্ব থাকে। যখন কোনো observer থাকে না, তখন সবকিছুই ‘vibrations’ আর ‘waves’ এবং তখন পদার্থের কোন অস্তিত্ব থাকে না। আর আমরা জানি ‘vibrations’ ছাড়া ‘sound’ কখনই সম্ভব না। যেখানে ‘sound’ আছে সেখানেই ‘vibration’ আছে। এজন্য, সৃষ্টির সাথে ‘sound’ বা শব্দের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
মানুষ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে এজন্যই মেতে ওঠে কারণ, কোন না কোন ভাবে মানুষ সৃষ্টির প্রতি ঈর্ষান্বিত। কারণ, সেই শিশুটি আজও তার জন্মলগ্ন প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পায়নি। আমরা যত ধরনের আর্ট বা শিল্পের কথা ভাবতে পারি তার সবই এই সৃষ্টির প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়ার কিছু ‘consequence’. আমাদের যে মাঝে মাঝে সুন্দর একটা আকাশ দেখলে তার ছবি তুলতে ইচ্ছা করে, আরো কয়েকজন কে দেখাতে ইচ্ছা করে, অনেক আকাঙ্ক্ষিত কোন কিছু পেয়ে গেলে আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করে বা গান গাইতে ইচ্ছা করে, অতীতের কোন স্মৃতি নিয়ে কবিতা লিখতে ইচ্ছা করে এই সব কিছুই সৃষ্টির প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়ার কিছু ‘consequence’. বিচ্ছিন্ন কিছুকে নির্দিষ্ট বিন্যাস দেওয়ার জন্য আমরা বিভিন্ন প্যাটার্নে সাজানোর চেষ্টা করি যাতে নতুন কোনো রূপ সৃষ্টি হয়। সুর বা মিউজিক এর ক্ষেত্রে সেটা ‘mathmetical pattern’, ‘geometrical pattern’. অক্ষর বা শব্দের ক্ষেত্রে সেটা ‘psychological pattern’. ফটোগ্রাফি এর ক্ষেত্রে সেটা ‘mathmatical pattern’, ‘rational pattern’. কোন না কোন ভাবে বিচ্ছিন্ন কিছুকে নির্দিষ্ট বিন্যাস দেওয়ার জন্য আমরা ‘complex pattern’ গুলো ব্যবহার করি এবং এতে নতুন কোনো রূপ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু এই নতুন রূপের সৃষ্টি আসলে নতুন নয়। এগুলো ঐ নবজাতক শিশুটি যে সৃষ্টি দেখে বিস্মিত হয়েছিল, সে সৃষ্টির যে সকল উপাদান, সেই উপাদানগুলোরই কিছু ‘permutations আর combinatons’, যেটাকে আমি বলছি সৃষ্টির প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়ার কিছু consequence. এই ‘permutations আর combinatons’ গুলো নতুন হওয়ার কারণে আমাদের মনে হয় আমাদের শিল্পকর্মও নতুন। এজন্য মানুষ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠে। সৃষ্টি করে। কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারলে সে ভাবে তার শিল্পকর্মও সুন্দর। সে চায় মানুষও এই সৌন্দর্য উপভোগ করুক, এই সৌন্দর্যের প্রশংসা করুক। এভাবে মানুষ নতুন ধরনের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খায়। সেটাও আর এক ধরনের আকাঙ্ক্ষার গোলকধাঁধা। প্রশংসার আকাঙ্ক্ষা। তার সুন্দর শিল্পকর্মের মাধ্যমে অর্থের আকাঙ্ক্ষা। মানুষ মনে করে পথ সরলরৈখিক। সেটা আবদ্ধ বৃত্ত, যেখান থেকে বের হওয়া যায় না। চাইলেও সে কখনোই বের হতে পারবেনা।
Komentáre